হযরত রাবিয়া বসরি (রহ.)

নবম শ্রেণি (মাধ্যমিক ২০২৪) - ইসলাম শিক্ষা - Islamic Study - আদর্শ জীবন চরিত | | NCTB BOOK
14
14

হযরত রাবিয়া বসরি (রহ.)

একক কাজ

'ইসলামে মহিয়সী নারী'

শিক্ষকের নির্দেশনা মোতাবেক উল্লিখিত শিরোনামের আলোকে তুমি মুসলিম মহিয়সী নারীদের একটি তালিকা করো।

যুগে যুগে পৃথিবীতে এমন ব্যক্তিবর্গও এসেছেন যারা মহান আল্লাহর অত্যন্ত প্রিয় ছিলেন। তাঁরা নবি-রাসুলগণের অনুসরণে মানুষকে সত্যপথের সন্ধান দিয়েছেন। এমনই একজন মহান ব্যক্তি ছিলেন হযরত রাবিয়া বসরি (রহ.)।

 জন্ম ও পরিচয়

হযরত রাবিয়া বসরি (রহ.) ৯৯ হিজরি মোতাবেক ৭১৭ খ্রিষ্টাব্দে ইরাকের বসরা নগরীতে জন্মগ্রহণ করেন। তাই তাঁকে বসরি বলা হয়। তাঁর পিতার নাম ইসমাঈল এবং মাতার নাম মায়ফুল। তাঁর পিতা খুব দরিদ্র ছিলেন। যেদিন রাতে তিনি জন্মগ্রহণ করেন, ঐ দিন রাতে তার পিতার ঘরে প্রদীপ জ্বালানোর মতো তেলও ছিল না। চার বোনের মধ্যে তিনি চতুর্থ ছিলেন। তাই তাঁর নাম রাখা হলো রাবিয়া (চতুর্থ)। শৈশবে তাঁর পিতামাতা ইন্তিকাল করেন। ফলে তাঁকে অতি কষ্টে দিনাতিপাত করতে হয়।

শিক্ষাজীবন

হযরত রাবিয়া বসরি (রহ.) খুব অল্প বয়সেই মা-বাবার কাছ থেকে কুরআন, হাদিস, ফিকহশাস্ত্রের জ্ঞান অর্জন করেছিলেন। শিক্ষা অর্জনের ক্ষেত্রে তার কখনো কোনো সংকোচ ছিল না। তিনি দরিদ্র হলেও পরম ধার্মিক ও আল্লাহভক্ত ছিলেন। তিনি ছিলেন ভদ্র, নম্র ও সংযমী। সেই সঙ্গে প্রখর বুদ্ধিমত্তার অধিকারিণী। সব সময় গভীর চিন্তায় ধ্যানমগ্ন হয়ে যেতেন। রাগ, হিংসা, অহংকার তাঁর চরিত্রকে কখনো কলুষিত করতে পারেনি। মোটকথা আল্লাহর একজন প্রকৃত অলি হওয়ার জন্য যে গুণাবলি থাকা প্রয়োজন এর সব কিছুই তাঁর মধ্যে বিদ্যমান ছিল। দীর্ঘ সাধনার পর রাবিয়া বসরি (রহ.) ইলমে তাসাউফ ও মারেফাতের সূক্ষ্ম জ্ঞান অর্জন করেন। পরবর্তী সময়ে রাবিয়া একজন কবি হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন।

ক্রীতদাসীর জীবন

হযরত রাবিয়া বসরি (রহ.)-এর মাতা-পিতার ইন্তিকালের পর তার বড় বোনেরা জীবন ও জীবিকার অন্বেষণে অন্যত্র চলে যান। নিঃসঙ্গ রাবিয়া বসরি (রহ.) কান্নাকাটি করে কাটাতে লাগলেন দিনের পর দিন। হঠাৎ এক পাষন্ড এসে জোর করে তুলে নিয়ে গেল রাবিয়া বসরি (রহ.)-কে। দাসী কেনাবেচার হাটে নিয়ে তাঁকে বিক্রি করে দিল পাষাণহৃদয় এক ব্যক্তির নিকট। ক্রীতদাসীতে পরিণত হলেন রাবিয়া বসরি (রহ.)। তিনি দিনের বেলায় কঠোর পরিশ্রম করতেন। রাতের বেলায় জাগ্রত থেকে আল্লাহ তা'আলার ইবাদাত করতেন। হঠাৎ এক মাঝরাতে তাঁর মনিবের ঘুম ভেঙে যায়। মনিব অস্পষ্ট কিছু কথার গুঞ্জন শুনতে পান। গভীর অন্ধকারে কার কথার শব্দ? খুঁজতে যেয়ে দেখতে পান রাবিয়া ইবাদাত করছে। আকুল স্বরে প্রার্থনা করছে প্রভুর দরবারে। একপর্যায়ে রাবিয়া মোনাজাত ধরে আল্লাহ তা'আলার দরবারে বললেন, হে আল্লাহ! তুমি আমাকে কোনো মানুষের অধীন করে না রাখলে আমি সর্বক্ষণ শুধু তোমার ইবাদাত করতাম। রাবিয়ার আকুল প্রার্থনা শুনে মনিবের মন গলে যায়। মনিব মনে মনে বলল, হায়! এ আমি কাকে আমার ঘরে দাসী বানিয়ে রেখেছি? সে তো সামান্য নারী হতে পারে না। সে নিশ্চয় আল্লাহর প্রিয়জন। এ ঘটনার পরদিন সকালে মনিব রাবিয়া বসরি (রহ.)-কে দাসত্ব জীবন থেকে মুক্ত করলেন। এবার রাবিয়া বসরি (রহ.) মুক্ত হয়ে নিজের জীবনকে তিনি উৎসর্গ করলেন প্রভুর ইবাদাতে। তিনি জীবনে বিয়ে করেননি। কেবল আল্লাহ তা'আলার ইবাদাতে কাটিয়ে দেন।

আল্লাহর ওপর আস্থা ও ইবাদাত

তাপসী রাবিয়া বসরি (রহ.) আল্লাহর ওপর বেশি নির্ভরশীল ছিলেন। তিনি জীর্ণ কুটিরে বসবাস করতেন। তবু কোনো মানুষের সাহায্য গ্রহণ করতেন না। একবার হযরত রাবিয়া বসরি (রহ.) অসুস্থ হলে আব্দুল ওয়াহিদ আমর ও প্রখ্যাত মুহাদ্দিস সুফিয়ান সাওরি তাঁকে দেখতে যান। তখন সুফিয়ান সাওরি হযরত রাবিয়া বসরি (রহ.)-কে বললেন, যদি আপনি দোয়া করেন, তাহলে আল্লাহ তা'আলা আপনাকে সুস্থ করে দেবেন। রাবিয়া বসরি (রহ.) বললেন, হে আবু সুফিয়ান! আপনি কি জানেন না কার ইচ্ছায় আমার এ অসুস্থতা? যার ইচ্ছা, তিনি কি আল্লাহ তা'আলা নন? সুফিয়ান বললেন, হ্যাঁ! রাবিয়া বসরি (রহ.) বললেন, তাহলে কেন আমাকে আল্লাহ তা'আলার ইচ্ছার বিরুদ্ধে প্রার্থনা করতে বলছেন। 

মালিক ইবনে দিনার একজন বিশিষ্ট মুহাদ্দিস ছিলেন। তিনি রাবিয়া বসরি (রহ.)-এর পরিচিত ছিলেন। তিনি একদা রাবিয়ার আর্থিক দুরবস্থা দেখে বললেন, আপনি বললে আমি আমার এক ধনী বন্ধু থেকে আপনার জন্য সাহায্য আনতে পারি। রাবিয়া বললেন, হে মালিক! আমাকে এবং আপনার বন্ধুকে কি আল্লাহই রিযিক দেন না? মালিক বলল, হ্যাঁ! রাবিয়া বললেন, আল্লাহ কি দরিদ্রকে তার দারিদ্র্যের কারণে ভুলে যাবেন এবং ধনীদের তাদের ধনসম্পদের কারণে মনে রাখবেন? মালিক বলল, না। তখন রাবিয়া বললেন, আল্লাহ যেহেতু আমার অবস্থা জানেন, তখন তাকে আমার আবার স্মরণ করানোর দরকার কী? বিশিষ্ট আরবি সাহিত্যিক আল জাহিজ বলেন, রাবিয়ার কয়েকজন পরিচিত লোক তাঁকে বললেন, আমরা যদি আপনার আত্মীয়স্বজনদের বলি তাহলে তারা আপনাকে একজন ক্রীতদাস কিনে দেবেন। রাবিয়া বললেন, সত্য কথা এই যে, যিনি সমস্ত পৃথিবীর মালিক, তার কাছেই পার্থিব কিছু চাইতে আমার লজ্জা হয়। অতএব যারা পৃথিবীর মালিক নয় তাদের কাছে কী করে আমি চাইতে পারি?

ইবাদাত করার ক্ষেত্রে হযরত রাবিয়া বসরি (রহ.) ছিলেন অতুলনীয়। তিনি যখনই সময় পেতেন, তখনই আল্লাহ তা'আলার ইবাদাতে ব্যস্ত হয়ে যেতেন। অধিকাংশ সময় তিনি দিনে রোযা রাখতেন আর রাতে নফল সালাত আদায় করতেন। তিনি সর্বদা আল্লাহ তা'আলার নিকট এ বলে প্রার্থনা করতেন যে, হে প্রভু! আমাকে আমার নিজ কাজে (ইবাদাতে) ব্যস্ত রাখুন যাতে আমাকে কেউ আপনার যিকির হতে বিমুখ করতে না পারে।

আধ্যাত্মিকতা

শুধু পুরুষরাই আল্লাহর নৈকট্য লাভ করেছে এমন নয়। অনেক নারীও আল্লাহর অলি হয়েছেন। আল্লাহ তাদের অনেক আধ্যাত্মিক ক্ষমতা দিয়েছেন। হযরত রাবেয়া বসরি (রহ.)-এরও অনেক আধ্যাত্মিক ক্ষমতা ছিল। একবার হযরত রাবিয়া বসরি (রহ.) খাবার রান্না করতে গেছেন। দেখেন পেঁয়াজ নেই। ভাবছেন, পেঁয়াজ কোথা থেকে আনব, কীভাবে আনব, কোনো দাস-দাসী নেই। সেবক সেবিকা নেই। মনে মনে এ কথাই ভাবছিলেন। এমন সময় লক্ষ করলেন, একটি চিল উড়ে যাচ্ছে। তাঁর পায়ে পেঁয়াজ। চিল পেঁয়াজগুলো ছুড়ে মারল, আর তা সোজা হযরত রাবিয়ার কাছে এসে পড়ল। তাঁকে বলা হলো, রাবিয়া! তুমি আমার হয়ে গেছ, আমি চিলকে তোমার সেবায় নিয়োজিত করলাম।

হযরত রাবিয়া বসরি (রহ.) একবার শস্য বুনছিলেন। পঙ্গপাল শস্যক্ষেতের ওপর এসে পড়েছিল। তখন রাবিয়া প্রার্থনা করে বললেন, হে আমার প্রভু! এ হলো আমার জীবিকা। যদি আপনি চান তাহলে আমি তা আপনার শত্রুদের বা বন্ধুদের দিয়ে দেব। তখন পঙ্গপাল উড়ে পালিয়ে গেল।

আল্লাহর অলিদের বহু অলৌকিক ঘটনা রয়েছে। তবে তারা এসব ক্ষমতা নিয়ে কখনো অহংকার করেননি। তারা ইচ্ছাকৃতভাবে কখনো তা প্রকাশ করেননি; বরং তা আপনা আপনি প্রকাশিত হয়ে যেত।

অনাড়ম্বর জীবনযাপন

হযরত রাবিয়া বসরি (রহ.) সহজ-সরল জীবনযাপন করতেন। তিনি সর্বদা নিজেকে খুব তুচ্ছ মনে করতেন। আল্লাহর নিকট বেশি বেশি ক্ষমা চাইতেন, সর্বদা আন্তরিকভাবে আল্লাহর নিকট তাওবা করতেন। তিনি বলতেন, মুখে মিথ্যা তাওবা করে কী লাভ যদি তা প্রমাণ করা না যায়? তিনি সর্বদা মহান আল্লাহর গুণকীর্তন ও মানব সেবায় রত ছিলেন।

রাবিয়া বসরি (রহ.)-এর ইন্তিকাল

অনেক শ্রম, কষ্টসাধ্য ও আধ্যাত্মিকতাপূর্ণ জীবনযাপন করার পর আল্লাহর প্রিয় এই নারী ১৮৫ হিজরি মোতাবেক ৮০১ খ্রিষ্টাব্দে বসরায় ইন্তিকাল করেন। তাঁকে বসরায় দাফন করা হয়।

বর্ণিত আছে যে, মুহাম্মাদ ইবনে তুসি নামক এক লোক তাঁর কবরে যান। গিয়ে বলেন যে, হে রাবিয়া, আপনি গর্ব করতেন যে, উভয় জগতের বিনিময়েও আপনি আপনার মাথা নত করবেন না। আপনি কি সেই উন্নত অবস্থা লাভ করেছেন? জবাবে একটি আওয়াজ এলো, আমি যা চেয়েছিলাম তা আমি পেয়েছি। আমরা তাঁর জীবনের আলোকে আমাদের জীবন গড়ব। ইহকাল ও পরকালে শান্তি পাব।

প্যানেল/দলে আলোচনা 

'হযরত হাসান (রা.) এবং হযরত রাবিয়া বসরি (রহ.)-এর জীবনাদর্শের মধ্যে তুলনামূলক বিশ্লেষণ' 

(উল্লিখিত দু'জন মনীষীর জীবনাদর্শের আধ্যাত্মিকতা, আত্মত্যাগ, শ্রমের মর্যাদা, সহনশীলতা প্রভৃতি ক্ষেত্রগুলো শিক্ষকের নির্দেশনা মোতাবেক তুমি প্যানেল বা দলে আলোচনা করে উপস্থাপন করো।)

 

Content added By
Promotion